ঢাকা , বুধবার, ০৪ জুন ২০২৫ , ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
পুলিশভ্যানে কাভার্ডভ্যানের ধাক্কা ৪ গাড়ি খাদে ঋণের বোঝা কমাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্য কমাল সরকার ঋণের বোঝা কমাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্য কমাল সরকার এক টাকা আয় করতে আড়াই টাকা ব্যয় তামান্নার উজ্জ্বল ত্বকের গোপন টিপস এক সিনেমায় দুই ক্লাইম্যাক্স! পাকিস্তানে টিকটকারকে গুলি করে হত্যা এবার এক সিনেমাতেই সাতটি চরিত্রে দেখা যাবে ইধিকাকে সংকটাপন্ন অবস্থায় অভিনেত্রী তানিন সুবহা এবার ঈদে মুক্তি পাচ্ছে নতুন ৭ সিনেমা এবার ঈদে মুক্তি পাচ্ছে নতুন ৭ সিনেমা প্রকাশ পেলো ‘তাণ্ডব’ এর ২য় গান বিশেষ ভাতা পাবেন হাওর-চর দ্বীপ এলাকার শিক্ষকরা ক্রীড়াঙ্গনের বাজেট বাড়ছে ২৪২৩ কোটি টাকার প্রস্তাব বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ কমেছে নির্বাচনী বছরে ইসি পাচ্ছে তিন হাজার কোটি টাকা যেসব পণ্যের দাম কমতে পারে বাড়বে যেসব পণ্যের দাম গণপরিবহনে নৈরাজ্য, দাপটে চলছে লক্কড় ঝক্কড় বাস ঈদযাত্রায় সড়কে দীর্ঘ জট রেলে ভোগান্তি

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বঞ্চনার গল্প যেন অরণ্যেরোদন

  • আপলোড সময় : ০২-০৬-২০২৫ ০৫:৩৯:০৩ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ০২-০৬-২০২৫ ০৫:৩৯:০৩ অপরাহ্ন
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বঞ্চনার গল্প যেন অরণ্যেরোদন
* বেতনের বৈষম্য ও জীবনযাত্রার মান * অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা, বঞ্চনার দীর্ঘশ্বাস * উপেক্ষিত দাবি, অটল সংগ্রাম বাংলাদেশে শিক্ষার চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছেন বিপুল সংখ্যক এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। যে শিক্ষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থী আলোকিত হচ্ছে। অথচ, এই শিক্ষকরাই আজ সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার। দাবি আদায়ে মাঠে নামা ছাড়া বিকল্প থাকে না তাদের। তবে আন্দোলনও বেশির ভাগ সময় অরণ্যে রোদন করার মতো হয়। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যে বিশাল ব্যবধান, তা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে নামমাত্র বেতনে তাদের টিকে থাকা যেন এক কঠিন সংগ্রাম। অথচ, নীতি-নির্ধারণী পর্যায় থেকে এই বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত। দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের গড়ে তোলার এই কারিগরদের জীবনমান উন্নয়নের কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা চোখে পড়ে না, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বেসরকারি মোট মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৯ হাজার। যেখানে শিক্ষক-কর্মচারী সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক এবং ১ কোটি ৬৫ লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। আর এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাণভোমরা হলেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। এত বড় একটি শিক্ষাব্যবস্থার অংশ হয়েও এই শিক্ষকদের প্রতি যে অবহেলা, তা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। বেতনের বৈষম্য ও জীবনযাত্রার মান: একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক যখন বেসরকারি স্কুল-কলেজে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তখন প্রবেশনারি পর্যায়ে জাতীয় বেতন কাঠামো অনুসারে ৯ম, ১০ম ও ১১তম স্কেলে তাদের বেতন শুরু হয়। কলেজ পর্যায়ের প্রভাষকরা ৯ম গ্রেডে বেতন পান, যেখানে স্কুল পর্যায়ের সহকারী শিক্ষকরা বিএড ছাড়া ১১তম গ্রেডে এবং বিএড থাকলে ১০ম গ্রেডে বেতন পান। শুনতে হয়তো মনে হতে পারে যে তারা জাতীয় বেতন কাঠামো অনুসরণ করছেন, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মাসিক নিট বেতনের দিকে তাকালে চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একজন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ৯ম গ্রেডের কলেজ প্রভাষক মাস শেষে হাতে পান মাত্র ২২ হাজার ৪০০ টাকা। অন্যদিকে, মাদ্রাসা, কারিগরি ও হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক ১১তম ও ১০ম গ্রেডে যথাক্রমে ১২ হাজার ৫০০ টাকা ও ১৭ হাজার ৫০০ টাকা পেয়ে থাকেন। এই বেতন দিয়ে বর্তমান বাজারে জীবনযাপন করা কতটা কঠিন তা সহজেই অনুমেয়। যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া, সেখানে একজন শিক্ষককে এই নামমাত্র বেতন দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে টিকে থাকতে হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, এই শিক্ষকরা টিউশনি বা অন্য কোনো উপার্জনের পথ খুঁজতে বাধ্য হচ্ছেন, যা তাদের মূল শিক্ষকতা পেশা থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছে এবং শিক্ষার মানকেও প্রভাবিত করছে। অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা, বঞ্চনার দীর্ঘশ্বাস: বেতনের পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা চরম বৈষম্যের শিকার। তাদের জন্য বাড়িভাড়া বাবদ বরাদ্দ মাত্র ১০০০ টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে অতিরিক্ত যুক্ত হয় মোট ১ হাজার ৫০০ টাকা। এই সামান্য অর্থ দিয়ে বর্তমান শহুরে জীবনে, এমনকি গ্রামীণ জনপদেও একটি মানসম্মত বাড়িভাড়া বা চিকিৎসার খরচ নির্বাহ করা প্রায় অসম্ভব। সম্প্রতি সরকার কর্তৃক ঘোষিত বিশেষ প্রণোদনা হিসেবে ৯ম ও ১০ম গ্রেডের জন্য ৫ শতাংশ হারে এবং অন্যান্য নিচের গ্রেডে যারা আছেন, তাদের জন্য ১০০০ টাকা দেয়া হয়েছে। যদিও এই প্রণোদনা কিছুটা স্বস্তি এনেছে, তবে এটি সামগ্রিক সমস্যার সমাধান নয়। বরং এটি যেন সাগর থেকে এক অঞ্জলি জল দেয়ার মতো। মোট বেতনের ওপর আবার অবসর-সুবিধা ও ভবিষ্যৎ কল্যাণ তহবিলের জন্য ১০ শতাংশ পরিমাণ টাকা কেটে রাখা হয়, যা তাদের হাতে আসা নিট বেতনকে আরও কমিয়ে দেয়। সরকারি শিক্ষকরা যেখানে শতভাগ উৎসব ভাতা পান, সেখানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা পান মাত্র ২৫ শতাংশ। বদলি ব্যবস্থা না থাকায় একজন শিক্ষককে একই প্রতিষ্ঠানে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে হয়, যা তাদের কাজের স্পৃহা ও কর্মজীবনের বৈচিত্র্যকে সীমিত করে ফেলে। উপেক্ষিত দাবি, অটল সংগ্রাম: দীর্ঘদিন ধরে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতাসহ অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি জানিয়ে আসছেন। অনেক সময় তারা মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও অনশনের মতো কর্মসূচিও পালন করেছেন। কিন্তু তাদের এই ন্যায্য দাবিগুলো বরাবরই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। শিক্ষাবিভাগ থেকে বিভিন্ন সময় আশার বাণী শোনানো হলেও, বাস্তবে খুব বেশি অগ্রগতি চোখে পড়েনি। শিক্ষকদের এই বঞ্চনা শুধু তাদের ব্যক্তিগত জীবনকেই প্রভাবিত করছে না, বরং এটি দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। একজন হতাশ ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষক কতটা মনোযোগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে পারবেন, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। মানসম্মত জীবনধারণের নিশ্চয়তা না থাকলে মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হবেন না, যার ফলে শিক্ষার মান আরও নিম্নমুখী হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। সুদূরপ্রসারী নীতিমালার প্রয়োজন: দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার ৯৫ শতাংশ শিক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বেসরকারি শিক্ষকদের এই বৈষম্য দূর করতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে সুদূরপ্রসারী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি: ১. বেতন বৈষম্য দূরীকরণ: সরকারি শিক্ষকদের মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষকদেরও পূর্ণাঙ্গ জাতীয় বেতন কাঠামো অনুযায়ী বেতন প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। তাদের বেতনের সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সমন্বয় সাধন করতে হবে, যাতে তারা পরিবার নিয়ে সম্মানজনকভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। ২. সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি: বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতাসহ সকল সুযোগ-সুবিধা সরকারি শিক্ষকদের সমপর্যায়ে উন্নীত করতে হবে। বদলি ব্যবস্থা চালু করা এবং পেনশন সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত করাও জরুরি। ৩. এমপিওভুক্তি প্রক্রিয়ার সরলীকরণ: বর্তমানে অনেক যোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক এমপিওভুক্তির বাইরে রয়ে গেছেন। এমপিওভুক্তি প্রক্রিয়াকে সহজ ও স্বচ্ছ করে সকল যোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এর আওতায় আনা উচিত। ৪. শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন: শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা নিজেদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারেন। ৫. নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে গুরুত্বারোপ: বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সমস্যাগুলোকে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের দাবিগুলোকে কেবল কর্মসূচি হিসেবে না দেখে সমস্যা সমাধানের আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর সেই মেরুদণ্ড সোজা করে রাখার কারিগর হলেন শিক্ষকরা। যদি এই কারিগররাই নিজেদের বঞ্চনার শিকার হন, তবে সেই মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে, শিক্ষার মানোন্নয়নের স্বার্থে এবং মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে হলেও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিগুলো পূরণ করা এখন সময়ের দাবি। তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারলে তবেই একটি শিক্ষিত ও উন্নত জাতি গড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে।

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স